Saturday, May 9, 2015

এক মহাজ্ঞানী সত্তা

Collected:
(নুমান আলী খান): ইবলিস এক মহাজ্ঞানী সত্তা। সে একজন জিন, যাদেরকে আল্লাহ ﷻ মানুষ সৃষ্টি করার অনেক আগেই সৃষ্টি করেছিলেন [আল-হিজর ১৫:২৭]। সে আল্লাহর ﷻ ইবাদত করে এতটাই উপরে উঠতে পেরেছিল যে, আল্লাহ ﷻ তার সাথে কথা বলতেন এবং আল্লাহর ﷻ মহাপরিকল্পনার অনেক কিছুই
সে জানত। এছাড়াও সে তার যোগ্যতার কারণে আল্লাহর ﷻ কাছের সন্মানিত ফেরেশতাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা, যার পর এত সন্মানিত এবং জ্ঞানী একজন সত্তা তার সবকিছু হারিয়ে ফেলল। আমরা অনেকেই ছোট বেলায় ইবলিসের এই অবাধ্যতার ঘটনাটা শুনেছি এবং ভেবেছি – “ছিঃ, ইবলিস কি বোকা, সে এত বড় ভুল কীভাবে করল।” আবার অনেকে ভেবেছি – “আহারে বেচারা ইবলিস। আল্লাহ ﷻ ইবলিসকে একটা মাত্র ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি দিলেন? এত বড় একজন সত্তাকে সারা জীবনের জন্য বের করে দিলো? শাস্তিটা বেশি হয়ে গেল না?” শুধু তাই না, এই ধারণা থেকে Devil Worshipper ‘শয়তান পূজারী ধর্ম’ তৈরি হয়ে গেছে, যার অনুসারীরা মনে করে: সেদিন ইবলিসের সাথে অন্যায় করা হয়েছিল।
আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার সেদিন কী ঘটেছিল। ধরুন, আপনি আপনার চাকরি জীবনের প্রথম থেকে একটা কোম্পানিতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছেন। গত ত্রিশ বছর কঠোর পরিশ্রম করে আপনি একজন মামুলি কেরানি থেকে আজকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আপনার সাথে কোম্পানির চেয়ারম্যানের অনেক ভালো সম্পর্ক, আপনি তার অনেক কাছের একজন মানুষ। কিন্তু হঠাৎ একদিন চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে বলল যে, সদ্য অক্সফোর্ড থেকে গ্রাজুয়েট একজন তরুন ছেলে কালকে থেকে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হবে এবং আপনাকে তার অধীনে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। আপনার অবস্থা তখন কী হবে? একজন সদ্য গ্রাজুয়েট হবে প্রেসিডেন্ট, আর আপনি যেখানে ত্রিশ বছর ধরে কোম্পানিতে কাজ করছেন, আপনি হবেন তার অধীনে একজন কর্মচারী! আপনার সাথে এতো বড় অন্যায়!
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ইবলিসের এই প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখানে অনেক চিন্তার ব্যাপার আছে। প্রথমত, আল্লাহর ﷻ অস্তিত্ব সম্পর্কে ইবলিসের সম্পূর্ণ ধারণা ছিল। আপনি, আমি নিজের চোখে আল্লাহকে দেখিনি, নিজের কানে আল্লাহকে শুনিনি। আমরা কোনো ফেরেশতাকেও কোনোদিন দেখিনি। আপনার-আমার পক্ষে আল্লাহর ﷻ প্রতি সম্পূর্ণ অবিচল, অটুট বিশ্বাস রাখাটা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু আল্লাহ ﷻ ইবলিসের সাথে নিজে কথা বলেছেন। এমনকি ইবলিস সন্মানিত ফেরেশতাদের সাথেও থাকত। তার জন্য আল্লাহকে ﷻ প্রভু হিসেবে মেনে কোনো ধরণের প্রশ্ন না করে, তাঁর আদেশ মেনে চলাটাই স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহর ﷻ অবস্থান কত উপরে এবং সে কত নিচে; আল্লাহর ﷻ অস্তিত্ব যে কত ব্যাপক, এবং সে আল্লাহর ﷻ তুলনায় কত দুর্বল একজন মামুলি সৃষ্টি—এগুলো তার খুব ভালো ভাবে জানা থাকার কথা। সৃষ্টি জগতের মধ্যে আল্লাহর ﷻ প্রতি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসী এবং সবচেয়ে বেশি অনুগতদের মধ্যে একজন হওয়ার কথা তার। কিন্তু এই সবকিছু দেখার, শোনার এবং জানার পরেও, সে কীভাবে আল্লাহর ﷻ আদেশের উপর সোজা ‘না’ করে দিল, সেটা এক বিস্ময়কর ঘটনা। কু’রআনে পরে কয়েকটি সূরায় আল্লাহ ﷻ ইবলিসের সাথে সেদিন তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল, তা আমাদেরকে জানিয়েছেন,
আল্লাহ বললেন, “ইবলিস, যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি তুমি অনুগত হতে পারলে না কেন? তুমি কি তখন অহংকার করছিলে, নাকি তুমি নিজেকে মহিমান্বিতদের একজন মনে করো?” – [সাদ ৩৮:৭৫]
স্রষ্টার কাছ থেকে এত কঠিন একটা প্রশ্ন সরাসরি শোনার পরে স্বাভাবিকভাবেই ইবলিসের উচিৎ ছিল সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া এবং স্বীকার করা যে, সে বড় ভুল করে ফেলেছে, তাকে মাফ করে দেওয়া হোক। কিন্তু সে তা না করে উলটো আল্লাহকে ﷻ বোঝানোর চেষ্টা করল,
সে বলল, “আমি ওর থেকে বড়। আপনি আমাকে আগুন থেকে বানিয়েছেন, আর ওকে বানিয়েছেন মাটি থেকে।” [সাদ ৩৮:৭৬]
ইবলিস কিন্তু বলতে পারত, “কত বছর ধরে আমি আপনার ইবাদত করছি, আপনার কত কাছের আমি,কত অনুগত; আর আজ আপনি আমাকে বলছেন নতুন একজনের কাছে নত হতে?” অথবা সে বলতে পারত, “আমাকে কেন ওই নতুন সৃষ্টির প্রতি অনুগত হতে হবে, তা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন কি, যাতে আমি নিজেকে বোঝাতে পারি?” সে এর কোনোটাই করেনি। সে ‘কার’ মুখের উপর ‘না’ বলছে, ‘কাকে’ যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে—সেটা সে ভুলে গিয়েছিল।
ইবলিসের এই মানসিকতা কিছু মানুষের মধ্যেও আছে। যেমন, চৌধুরী সাহেব মনে করেন: পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, ত্রিশটা রোজা রাখার আসলে কোনো দরকার নেই। এই সব নামায, রোজা শুধু ওই সব অর্ধ-শিক্ষিত, অল্প-জ্ঞানী ‘মোল্লা’ টাইপের মানুষদের জন্য দরকার, যারা এখনও তার মত চিন্তার গভীরতা এবং উপলব্ধির উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়া একজন মানুষ, সৃষ্টিজগত, বিজ্ঞানের উপর কয়েক ডজন বই পড়েছেন, ডিসকভারি চ্যানেলে শখানেক ডকুমেন্টারি দেখেছেন। তিনি আল্লাহকে ﷻ যতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, সেটা সবাই পারে না। একারণেই তার মত মানুষদের এইসব গৎবাঁধা নামায, রোজার দরকার হয় না। এভাবে তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, কুরআনের সব নির্দেশ আসলে তার জন্য প্রযোজ্য না।
“মহান আল্লাহ ﷻ সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, সর্বশক্তিমান, একমাত্র প্রভু এবং আমি আল্লাহর ﷻ এক মামুলি দাস”—এটা ইবলিস এবং এই চৌধুরী সাহেব টাইপের মানুষরা ঠিকভাবে নিজেদেরকে বোঝাতে পারেনি। তারা আল্লাহকে ﷻ সৃষ্টিকর্তা মানে ঠিকই। কিন্তু তিনি যে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে একজন প্রভু—এটা মানে না।
ইবলিস শুধু আল্লাহর ﷻ সাথে যুক্তিতর্কই করেই শেষ করেনি, তার মধ্যে কখনোই কোনো ধরনের অনুশোচনাও ছিল না। একে তো সে আল্লাহর ﷻ আদেশ অমান্য করল, তার উপর উল্টো সে তার স্রষ্টাকেই যুক্তি দিয়ে বোঝানোর মতো ঔদ্ধত্য দেখাল। এখানেই শেষ নয়, নির্বাসিত হওয়ার পর এই বলে সে প্রতিজ্ঞা করল যে, যে মানবজাতির সৃষ্টি নিয়ে আজ তার এই অবনমন, সেই মানবজাতিকে কিয়ামাত পর্যন্ত সে বিভ্রান্ত করে যাবে। কিন্তু একবারও সে তার অহংকারকে দমিয়ে আল্লাহকে ﷻ বলতে পারল না, “ও আল্লাহ্‌, আমি ভুল করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন, আমাকে আর একটা বার সুযোগ দিন।” তার অহংকার এতই বেশি ছিল যে, সে চিরকালের জন্য জাহান্নামে যেতেও রাজি ছিল, কিন্তু তারপরেও সে কারও কাছে মাথা নত করবে না। এমনকি তার স্রষ্টার কাছেও না!
এখানেই মানুষ আর ইবলিসের মধ্যে পার্থক্য। মানুষ ভুল করে আল্লাহ্‌র ﷻ কাছে ক্ষমা চায়—যা আমরা আদম (আ) এর কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু একজন শয়তান ভুল করে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চায় না।
আমরা ইবলিসের এই ঘটনা থেকে আর কিছু না শিখি, একটি জিনিস অন্তত আমাদের শেখা দরকার, সেটা হচ্ছে: অহংকার না করা এবং অহংকারের চোটে অন্ধ না হওয়া। জীবনে কত বার আমরা মানুষের সাথে খামোখা তর্ক করেছি শুধুই তর্কে জেতার জন্য; নিজের মধ্যে এটা বোঝার পরেও যে, আমাদের যুক্তিতে-বোঝায় ভুল আছে? কতবার আমরা, বয়সে ছোট একজনের কাছে মাথা নত করব না, এই অন্ধ অহংকারের ফলে অনেক ভালো উপদেশ, অনেক সাহায্য, সুযোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি? কতবার আমরা স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেও, কোনোদিন তাদের কাছে একটি বারও মাফ চাইনি, পাছে আমাদের খানদানি সন্মান চলে যায় ভেবে? কতবার আমরা নিচের পদের কর্মচারী, বাসার কাজের লোক, ড্রাইভারদের সাথে অন্যায় ব্যবহার করেছি, কিন্তু সেটা পরে এক সময় বোঝার পরেও—“ওরা সস্তা মাটির তৈরি, আমি দামি মাটির তৈরি”—এই অহংকার বোধ থেকে একটি বারও তাদের কাছে গিয়ে নিজেদের দোষ স্বীকার করিনি? আমরা যদি নিজেদের অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে যেটা করা উচিত সেটা করতে না পারি, যখন ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন তখন ক্ষমা চাইতে না পারি, যেখানে নিজের দোষ মেনে নেওয়া দরকার সেখানে নিজের দোষ মেনে নিতে না পারি, তাহলে ইবলিস যে কাজ করেছিল, আমরাও সেই একই কাজই করছি। সেক্ষেত্রে আল্লাহ্‌ ﷻ তাকে যেই পরিণতি দিয়েছেন, আমাদেরকেও সেই পরিণতি দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত—তাহলেই ইবলিস এবং আমাদের সাথে ন্যায়বিচার করা হবে।

No comments:

Post a Comment